
ট্রেতে চারা, মেশিনে রোপণ – সময় কম, ফলন বেশি
ট্রেপদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করে ধান চাষে সফলতা পাচ্ছে কৃষক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গোল্ডেন বার্ন কিংডম (জিবিকে) উদ্ভাবিত এই পদ্ধতিতে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে ধান চাষে ফলন বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। ‘ট্রে’ পদ্ধতিতে সময়, শ্রম এবং ব্যয়ও কম।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ পদ্ধতি জনপ্রিয় করা গেলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি চাল রপ্তানির ক্ষেত্রেও দারুণ অগ্রগতি হবে।
‘ট্রে’ পদ্ধতি
ট্রে’র ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ রাসায়নিক ব্যবহার করে রোগ প্রতিরোধ এবং সার মিশ্রিত বিশেষ ধরনের মাটি নিয়ে এর ওপর চারা রোপনের পর তা ১৩ থেকে ১৫ দিন পর মাদুরের মতো করে তোলা হয়। এরপর বেঁধে রোপন যন্ত্রের (রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার) মাধ্যমে মাঠে রোপন করা হয়। এ পদ্ধতিতে একজন শ্রমিক একটি মেশিন দিয়ে দিনে প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে ধানের চারা রোপন করতে পারেন।
ট্রে পদ্ধতিতে চারা টেনে তুলতে হয় না বলে শিকড়ও ছেড়ে না। ফলে শিকড় দ্রুত মাটি থেকে খাদ্য গ্রহণ করে এবং গাছ সবল হয়ে বেড়ে ওঠে।
পদ্ধতির প্রচলন
১৯৬২ সালে জাপানে ট্রে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। বর্তমানে জাপানে সনাতনী ব্যবহার বন্ধ। ১৯৭৫ সালে তাইওয়ানে ব্যবহার শুরুর পর বর্তমানে ৯৩ শতাংশ জমিতে এ পদ্ধতির ব্যবহার চলছে। কয়েক বছর আগে চীনেও ট্রে পদ্ধতির প্রচলন শুরু হয়। দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার এ প্রযুক্তি ব্যবহারে চাষীদের ৭৫ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে। এছাড়া প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ থেকেও দেওয়া হচ্ছে ১৫-১৮ শতাংশ সহায়তা।
বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে জিবিকে
গত তিন বছর ধরে ‘ট্রে’ পদ্ধতির মাঠ প্রদর্শনী করছে গোল্ডেন বার্ন কিংডম (জিবেকে) লিমিটেড। গত বছর বোরো চাষের পর এবার আমন চাষে কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও বগুড়ার মাঠ প্রদর্শনীতে ব্রি-৪৯ ধানের চারায় সনাতন পদ্ধতির থেকে গড়ে ৪৩ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।
মাঠ প্রদর্শনীতে সফলতা
শুক্রবার টাঙ্গাইলের মধুপুরে বিএডিসি খামারের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় যান্ত্রিক পদ্ধতিতে রোপনকৃত ধানের ফসল কাটা হয়। এসময় বিএডিসি’র জিএম (বীজ) ড. আজিজুল হক ও প্রজেক্ট ডিরেক্টর (বীজ) আশুতোষ লাহেড়ী, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) মধুপুরের জয়েন্ট ডিরেক্টর কৃষিবিদ মো. সুলতান গিয়াস উদ্দিন, জিবেকে’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহদাব আকবর ও সিইও মাসুদ জামান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
মধুপুর বিএডিসি খামারে ট্রে পদ্ধতিতে বিনা-৭ জাতের ধানের উৎপাদন আসে হেক্টর প্রতি ৬ দশমিক ৪৯ মেট্রিক টন। আর পাশেই বিএডিসি খামারে সনাতন পদ্ধতিতে ফলন পাওয়া যায় হেক্টর প্রতি ৪ দশমিক ৭৬ মেট্রিক টন। অর্থাৎ সনাতনী থেকে ট্রে পদ্ধতিতে উৎপাদন বেড়েছে ৩৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
চলতি আমন মৌসুমে রাজশাহীর তানোর উপজেলার তালন্দ গ্রামে নুরুল ইসলাম, আবু বকর ও মোশাররফ হোসেনের জমিতে সনাতন পদ্ধতিতে ফল ছিল ৫ দশমিক ৬০ মেট্রিক টন, যেখানে ট্রে পদ্ধতিতে এসেছে ৮ দশমিক ১৬ মেট্রিক টন। অর্থাৎ ট্রে পদ্ধতিতে ফল ছিল ৪৫ দশমিক ৭১ শতাংশ বেশি।
বগুড়ার শেরপুর উপজেলার টুনিপাড়ায় আব্দুল হান্নান, আব্দুস সালাম ও আব্দুল মান্নান ট্রে পদ্ধতিতে ফলন পেয়েছেন ৪৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি।
একইভাবে কুষ্টিয়া সদরের বাড়াদি গ্রামে তিন কৃষকের জামিতে চাষকৃত সনাতন পদ্ধতির থেকে ট্রে পদ্ধতিতে ফলন ছিল হেক্টর প্রতি ৪৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি।
টাঙ্গাইল, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও বগুড়ায় মাঠ প্রদর্শনীতে ট্রে পদ্ধতিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে গড়ে ৪৩ দশমিক ৭১ শতাংশ।
জিবিকে এর আগে ট্রে পদ্ধতিতে বোরো মৌসুমে কাশিমপুর মুক্তাগাছায় বিএডিসি খামারে তাইওয়ানের এম-১ জাতের ধান থেকে হেক্টর প্রতি উৎপাদন এসেছে ৯ দশমিক ৮০ মেট্রিক টন। এ মৌসুমেও এই ধানের উৎপাদন হয়েছে ৭ মেট্রিক টন। রোপনের মাত্র ৮০ দিনের মাথায় এ ধানের সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে উপমহাদেশ তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।
সুবিধা
এই পদ্ধতির অন্যতম সুবিধা হলো চারার শিকড় ছেড়ে না বলে অল্প সময়ে মাটির সঙ্গে লেগে যায়। সনাতন পদ্ধতিতে চারগুণ বেশি জায়গা লাগে বীজতলার জন্য। ট্রেতে করে উৎপাদন করতে জায়গা লাগে কম। ঝড়-বৃষ্টি বা প্রাকৃতিক যে কোনো মুর্যোগে নিরাপদ স্থানে উঠিয়ে রাখা যায়। খরচ কম বলে এ প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষিশ্রমিকের সংকট নিরসন এবং ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
উৎপাদন বৃদ্ধি করে সেবা দিতে চায় জিবিকে
এবছর জিবিকে ৫শ’ বিঘা জমিতে ট্রে প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। ২০ হাজার বিঘার চারা তৈরির ক্ষমতা আছে। প্রতি বিঘা জমির জন্য ১৩শ’ টাকা দিলে কৃষকের পছন্দের বীজ বিএডিসি থেকে সংগ্রহ করে এবং তা ট্রেতে উৎপাদনের পর জমিতে চারা লাগাবে জিবিকে।
জিবেকে’র এমডি শাহদাব আকবর বাংলানিউজকে বলেন, “অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে বিভিন্ন দেশ আগ্রহ বাড়াচ্ছে। গোল্ডেন বার্ণ কিংডমের মাদার প্রতিষ্ঠান সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি ‘গোল্ডেন বার্ন ইনক’ কম্বোডিয়ায় ৮০ হেক্টর একর জমিতে চাষাবাদের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।”
তিনি আরও জানান, “গত তিন বছর ধরে আমরা বিশ্বাসীকৃত অত্যাধুনিক এ প্রযুক্তিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধান চাষে মাঠ প্রদর্শনী করে আসছি। ফলন বাড়ায় কৃষকদের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের তরুণ-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কৃষকদের কাছে আরও জনপ্রিয় করা গেলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি চাল রপ্তানি করতে সক্ষম হবে। এজন্য সরকার ও কৃষকদের সহযোগিতা বিশেষ প্রয়োজন।
সময়োপযোগী প্রযুক্তি
ট্রে পদ্ধতিকে এরই মধ্যে সাধুবাদ জানিয়েছে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বিএডিসি ও ব্র্যাক।
বিএডিসি’র জিএম (বীজ) ড. আজিজুল হক বাংলানিউজকে বলেন, “বীজতলার জায়গা, শ্রম ও সময় কম লাগে, ঝুঁকিও নেই। মৌসুমী শ্রমিকের অভাবে চাষাবাদ বাধাগ্রস্ত হবে না। কৃষকরা তুলনা করে ব্যবহার করবে। জিবিকে যে যান্ত্রিক প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে তা সময়োপযোগী। কারণ, ভবিষতে আমাদের যান্ত্রিকতার দিকেই যেতে হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এবং বীজ উইংয়ের মহাপরিচালক আনোয়ার ফারুক বলেন, “ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে যেভাবে ফসলি জমি কমতে শুরু করেছে, সে অবস্থায় ট্রে পদ্ধতির ব্যবহার খুবই সময়োপযোগী। অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তি কৃষকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে পারলে তা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে।”
তথ্যসুত্রঃ বাংলানিউজ